Obituary- Sad demise of Md. Imamul Kabir Shanto, Honourable Chairman, Board of Trustees, Shanto-Mariam University of Creative Technology

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত :
‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে…’

ড. নিজামউদ্দিন জামি

সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ৩০ মে শনিবার ভোরে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্ণধার, দৈনিক আজকের প্রত্যাশার সম্পাদক, গরিবের বন্ধু, কর্মবীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। তিনি পরিবারের ভাইবোনদের সবসময় সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতেন, আগলে রাখতেন। বাবা-মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করে তিনি প্রতি বছর মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও তিনি ভাইবোনসহ অসংখ্য আত্মীয় শুভার্থী রেখে যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।

শ্বাস কষ্ট নিয়ে তিনি গত ২২ মে ঢাকার মগবাজার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে গত ২৭ মে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘ নয়দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে আজ ভোরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ব্যবসায়ী মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। কর্মীদের হাউ-মাউ কান্নায় নিজ নিজ কর্মস্থল ভারী হয়ে উঠে। বিকেল সাড়ে তিনটায় জানাজা শেষে বনানীর কবরস্থানে শেষইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের বুকে তিনি চিরশায়িত হন। ‘মৃত্যু মানে নতুন পথে যাত্রা।’

তিনি বারবার মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এলেও এ যাত্রায় তাঁকে আর ফেরানো যায়নি। অপরিসীম স্মৃতিশক্তি, অমিত সাহস ও উদাহরণীয় কর্মোদ্যোগ, সরল মানবিকতা, প্রবল ব্যক্তিত্ব তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রতিষ্ঠানের উঁচুস্তর থেকে শুরু করে অফিস সহকারী পর্যন্ত সর্বস্তরের সকলের সাথে কথা বলতেন হাসিমুখে, ব্যক্তিগত-পারিবারিক খবরাখবর নিতেন। সহকর্মীদের শাসনের সাথে সাথে কীভাবে ভালোবাসতে হয় তিনি তাঁর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিঃসঙ্গ ও নিঃসন্তান ছিলেন। প্রায় দুই ডজন প্রতিষ্ঠানকে তিনি সংসার, আর কর্মীদের সেই সংসারের সদস্য মনে করতেন। তাঁর ধ্যানজ্ঞানের মূলে ছিল প্রতিষ্ঠান ও এর সাথে যুক্ত মানুষগুলির কথা। তাঁর অনুজ প্রতিম ডা. মো. আহসানুল কবীর শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর পাশে থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ‘শান্ত ভাই’, ‘শান্ত স্যার’ নামে তিনি সর্বজনের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।

জনাব শান্ত মাত্র ১৭ বছর বয়সে জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ বিষাদের আরেক ছায়ায় ঢেকে যায়। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রথম প্রহরে তাঁর সহমুক্তিযোদ্ধা এগারোজনের সলিল সমাধি হয় বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবিতে। তাঁরা সকলে ঢাকায় ফিরছিলেন, বিজয়ের মিছিলে যোগ দিতে। সেই বন্ধু-সহমুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষা ও অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফাউন্ডেশন।’ এভাবে তাঁর প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের গোড়ায় আছে একেকটি মহৎ ইতিহাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজ করে শিক্ষা-ব্যয় নির্বাহ করতে পারে, সেজন্য ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষাসহায়ক অনেক প্রতিষ্ঠান। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে কেউ যেন বেকার না থাকে, সেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কর্মবীর মো. ইমামুল কবীর শান্ত। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন।

তিনি সবসময় বলতেন, ‘জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করাই আমার লক্ষ্য। এটা আমার জন্য আরেকটি যুদ্ধ।’ এ যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন বারবার। শেখ হাসিনার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করতেন। এ পরিবারের কথা বলতে বলতে অনেক সময় তাঁর চোখ ভিজে যেতো। তারপরও তিনি এ সান্ত্বনা নিয়ে যেতে পেরেছেন যে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুঃসময়ে পাশে থাকার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল করতে গিয়ে তাঁর অনেক সতীর্থ প্রাণ হারান। মামলা ঝুলে অনেকের নামে। সেই হামলা-মামলার শিকার হন বঙ্গবন্ধু ভক্ত তরুণ মো. ইমামুল কবীর শান্তও। বঙ্গবন্ধুর ভক্তদের দেশে থাকা যখন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তখন তিনি বিদেশে পাড়ি জমান। জার্মানিতে থিতু হন। সেখানে চিরজীবন কাটিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। জার্মানিদের দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন। তাঁর ভেতরে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয় এই ভেবে যে, দুই দুইবার বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েও যদি জার্মানিরা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, তাহলে বিজয়ী জাতি হিসেবে বাঙালিরা কেন পারবে না? এ জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে খুঁজতে তিনি দেশে না আসার সিদ্ধান্ত পরিহার করে দেশের মাটিতে পা রাখেন। এ যেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের আকুতি! ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।’ সেই দেশের মতো বাংলাদেশেও একটি শিক্ষা মডেল তিনি উপস্থাপন করেছিলেন পরবর্তী সময়ে।

কিন্তু দেশসেবা করতে হলে তো টাকার দরকার আছে। উপায় কী? তাই ১৯৮৩ সালে তিনি শুরু করেন সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস। তাঁর সততা ও কর্মোদ্যোগে এ ব্যবসা দ্রুততম কুরিয়ার হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি পায় এবং মানুষের আস্থা অর্জন করে। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

তারপর এক এক করে তাঁর স্বপ্নের চারাগাছ বপন করতে থাকেন। শান্ত-মারিয়াম ইনস্টিটিউট অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি। যা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের এডেক্সেল ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। এরপর সাংস্কৃতিক শিক্ষার পথ প্রশস্ত করতে প্রতিষ্ঠা করেন শান্ত-মারিয়াম একাডেমি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।

এ শিক্ষা কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এ অঞ্চলের অন্যতম কর্মমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার উচ্চ বিদ্যাপীঠ ‘শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুসারে এটি ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা পূরণ ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে গত একযুগ থেকে প্রকাশ করে আসছেন দৈনিক আজকের প্রত্যাশা। এছাড়াও শান্ত-মারিয়াম ফ্যাশনস, ক্রিয়েটিভ দ্য আর্ট মল, আর্ট হাট অ্যান্ড আর্ট গ্যালারি, ডিজাইন ডেসটিনেশন,
শান্ত-মারিয়াম প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিংসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ব্যবসাসহায়ক প্রতিষ্ঠানসমূহ অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি সুদক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাঁর কেন্দ্রীয় স্লোগান ছিল Creative Destination of the Nation অথবা জাতির সৃজনশীলতার গন্তব্য। জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল এ জাগরণী মন্ত্র।

তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ ছিলেন। জাতপাতের সংকীর্ণতা তাঁকে কখনোই স্পর্শ করেনি। মাদার তেরেসা, চে গুয়েভারার জীবনী পড়ে তিনি উজ্জীবিত হন। তবে তাঁর জীবন ও কর্মের সর্বোচ্চ আসনে ছিলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনে তিনি অনেক পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। ‘খোকা থেকে জাতির পিতা’, ‘খোকার প্রত্যাশা’, ‘খোকা থেকে বিশ্ববন্ধু’ ইত্যাদি নামে সেমিনার করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।
তিনি প্রকৃতঅর্থে সংস্কৃতিবান ও রুচিশীল মানুষ ছিলেন। সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে এদেশকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি যে দার্শনিক তত্ত্ব দিয়েছেন, তা অত্যন্ত মূল্যবান। আশা করি ভবিষ্যত গবেষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এটি। তিনি বলেছিলেন- ‘ধর্ম মানুষের বিশ্বাস কিন্তু সংস্কৃতি হচ্ছে সকল ধর্মের, সকল গোত্রের মানুষের বন্ধন।’ এ সম্প্রীতিই মানবতার রক্ষাকবচ। তিনি সম্প্রীতির বাংলাদেশের জন্য কাজ করে গেছেন আমরণ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ভেতর দিয়ে তিনি তার অভীষ্টে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।

গত ১৭ মার্চ তিনি মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কীভাবে সাহায্য করা যায়, পাশে দাঁড়ানো যায় এ নিয়ে তিনি বিচলিত ছিলেন। কাজের অংশ হিসেবে একটি রিসার্চ টিমের পরিকল্পনাও করেন। খুলনায় বাগেরহাটে তাঁর নিজের এলাকায় ত্রাণ, মাস্ক ও পিপি বিতরণ করেই শেষ করেননি, ‘শান্ত নিবাস’কে আইসোলেশন সেন্টার করে সরকারের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনাও গ্রহণ করেন এ মানবহিতৈষী।

শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন একটি বীজতলা। এখানে প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং সুনামের সাথে কাজ করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী বেকার নেই-এটা তাঁর জীবনের অন্যতম সফলতা।

শুধু তাই নয়, তিনি ‘শান্ত নিবাস’ নামে বিশাল এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যাতে পথশিশু, হতদরিদ্র, এতিম, জেলখানার শিশু ও পতিতালয়ের অবহেলিত শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।

তাঁর কাছে যারা চাকরি চেয়েছেন, পারতপক্ষে কাউকে বিমুখ করেননি। চাকরি দিয়ে দিয়েছেন, বেতনও চলছে কিন্তু ঐ কর্মীকে কাজ দেয়া হয়নি। এভাবে বছরের পর বছর অনেক মানুষ শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন থেকে সুবিধাভোগ করেছেন মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র বদান্যতা ও প্রযত্নে।

বাংলাদেশে কর্মমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রসারে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনন্য অসামান্য। এ জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার দাবি রাখেন। ব্যক্তি উদ্যোগে এক্ষেত্রে তিনি অনন্য, অদ্বিতীয়ও বটে।

পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে চাই, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।’ মো. ইমামুল কবীর শান্ত, দিনান্তের শ্রদ্ধা নিবেদন করি আপনার শেষ ঠিকানায়। আজই মায়ের কোলে শায়িত হবেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। হে আল্লাহ, তুমি তোমার প্রিয় বান্দা ও তোমার প্রিয় হাবিবের (দ.) প্রিয় উম্মত হিসেবে তাঁকে গ্রহণ কর, বরণ কর। নিশ্চয় তুমি দয়াবান।
————————————–
ড. নিজামউদ্দিন জামি
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়

News & Events